STORY
- Darbesh Patrika
- Jun 16, 2022
- 26 min read
Updated: Jul 28, 2022
পত্রবন্ধু
Manidipa Das Bhattacharya
California, USA

আমি অনুরূপা। এই গল্পের শুরু যে সময়ে, তখন আমার বয়েস ১০ বছর। আমার জন্ম ১৯৮৪ সালে। বাড়ি বর্ধমানের মোহনপুর বলে একটা গ্রামে।
আজকের মত, মোবাইল ফোনের কোন চল ছিল না। বাহুল্য বর্জিত জীবনে, ছিল বেঁচে থাকার অনেক রসদ।
আজকাল কেন জানি না, বড় বেশি করে মন পুরোনো কে, আঁকড়ে ধরতে চায়। সাদা কালো স্মৃতির অলি গলি ধরে, পৌঁছে যেতে ইচ্ছে করে, আমার ফেলে আসা শৈশবে। আসলে সবকিছুরই শুরুটাই বোধহয় ভালো লাগে, তারপর অজস্র ব্যস্ত সময়ের ভিড়ে, সেই ভালো লাগাটাই কখন যেন ফিকে হয়ে আসে। আস্তে আস্তে কেমন যেন জোর করেই ভুলে যাচ্ছি, আমারও একটা শিকড় ছিল। যে শিকড়ে জড়িয়ে ছিল, একটা খুব মধ্যবিত্ত পাড়ার গলি, দুপুরের ছাদের আলতো রোদে পিঠ তাপানো, মায়ের হাতের আচার নিয়ে আঙুল চাটা, রঙিন চুড়ির টুং টাং শব্দ। বোরোলীনের গন্ধ, শীতের দুপুরে, কমলা লেবু খেতে খেতে, ফাটা হাতে পায়ে গ্লিসারিন মাখা, পাশের পাড়ার কাটা ঘুড়ির ভোঁ কাট্টা।
৯০ এর দশকে আমার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গী ছিল,আমার গল্পের বই। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি, যাকে বলে গল্পের বই এর পোকা ছিলাম।
আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আসত, ছোটদের জন্য শুকতারা, আনন্দমেলা, চাঁদমামা এই জাতীয় সব ছোটদের মাসিক পত্রিকা।
সেই সব বই হাতে পেতে যা সময়, গোগ্রাসে শেষ ফেলতাম এক একটি বই।
ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরে, কোনোমতে মায়ের সাজিয়ে রাখা ভাত ডাল, মাছের ঝোল খেয়েই দৌড় লাগাতাম, বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে। নীল আকাশের তলায়, সবুজ ঘেরা মাঠে একদল কচিকাঁচা মিলে আমরা খেলে বেড়াতাম।কখনো কুমির ডাঙ্গা, কখনো লুকোচুরি, রুমালচোর বা কানামাছির মতো অনেক মজার সব খেলা আমরা খেলতাম।
সূর্য্য ডোবার আগেই, বাড়িতে ঢুকতে হবে। এটাই ছিল মায়ের হুকুম। সেই হুকুমের এদিক ওদিক হলেই সেদিন সন্ধ্যে আপাদমস্তক মারও জুটতো কপালে।
খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরে কলতলা থেকে হাত মুখ ধুয়ে, সান্ধ্যকালীন জলখাবার, দুধ কলা সহযোগে মুড়ি মাখা, যা কিনা আমার নিত্য দিনের সন্ধ্যের খাবার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কচিৎ কদাচিৎ, আলু, ডিম দিয়ে চীনা খাবার চাউমিন ও জুটতো, তবে সে মাসে ২দিনের বেশি নয়।
তারপর ঘন্টা খানেক মতন, হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধতে বসতাম। আমার সারেগামা রেওয়াজ আমার বাড়ির লোকের চেয়ে পাশের বাড়ির লোকের কানে বোধহয় বেশি পৌঁছত। কারণ মায়ের কড়া হুকুম, গলা ছেড়ে রেওয়াজ করতে হবে। যথারীতি রেওয়াজ শেষ করে, বই নিয়ে লক্ষী মেয়ের মত, পড়তে বসে যেতাম। এবং পড়া শেষ করেই দৌড়োতাম আমার সারাদিনের সবথেকে প্রিয় কাজটি করতে। আমার বাড়িতে আসা প্রিয় মাসিক পত্রিকা গুলো নিয়ে বসতাম এইসময়।
মফস্সল বলে, খুব কারেন্ট চলে যেত সেই সময়। তবে সেসবের তোয়াক্কা কখনোই করতাম না আমি। মা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দিলে, সেই হ্যারিকেনের আলোয় পরে ফেলতাম বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা-ভোঁদা থেকে শুকতারা, আনন্দমেলার সব গল্প। এর মধ্যে আমার হঠাৎই বিশেষ ভাবে ভালো লেগে গেলো, শুকতারার প্রকাশিত দুটি বিভাগ। এক: দাদুমণির চিঠি, আর দুই: পত্র বন্ধু।
আমারই মত কতো ছেলে মেয়েরা সেই বিভাগ গুলিতে চিঠি পাঠাতো। আর দাদুমণি সেইসব চিঠির উত্তর দিতেন।
সেখানে সবাই লিখতো, তাদের দিন যাপনের গল্প। তাদের ভালোলাগার কথা।
হঠাৎই আমার কি ইচ্ছে হলো, আমি পত্র বন্ধু খুঁজলাম। বাড়িতে তখন প্রায়ই বাবা পোস্ট কার্ড এনে রাখতেন। সেখান থেকে একটা পোস্টকার্ড নিয়ে, একদিন সাহস করে চিঠি লিখে ফেললাম এক বন্ধু কে। আমি কে, আম কোথায় থাকি, কোন ক্লাসে পড়ি, কি করতে ভালোবাসি, এইসবই ছিলো মুলতঃ সেই চিঠির বিষয় বস্তু।
আমার ইস্কুল যাবার পথেই ছিল আমাদের গ্রামের পোস্ট অফিস। পোস্টকার্ডের ওপর পেন্সিল দিয়ে সেই বন্ধুর ঠিকানা লিখে একদিন ইস্কুল যাবার পথে, পোস্ট অফিসে ঢুকে সামনে রাখা লাল রঙের পোস্ট বাক্সর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম আমার লেখা সেই চিঠি আমার পত্র উদ্দেশ্যে।
এরপর প্রায় একমাস কেটে গেছে। আমার রোজকার জীবন চলছিল, জীবনের নিয়ম মেনেই। আমি রোজ সকালে উঠে ইস্কুলে যাই, বিকেলে পাড়ার মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলা করি, বাড়ি ফিরে সারেগামা প্র্যাকটিস করে পড়তে বসি।
এরই মধ্যে কোনো এক দিন সকালে ইস্কুলে বেরোবার সময়, পিওন কাকু এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। আর আমাকে অবাক করে দিয়েই, ডেকে উঠলো, অনুরূপা মুখার্জীর নামে চিঠি আছে! বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি আমার তখনও! মনে মনে বললাম, আমার নামে চিঠি?
মা জানত, আমি কোনো এক পত্রবন্ধু কে চিঠি লিখেছিলাম। সেই কথাই আমাকে মনে করিয়ে দিলো মা।
----বলল দেখ তোর সেই পত্রবন্ধুই বোধহয় তোকে তোর চিঠির উত্তর দিয়েছে।
ভীষণ আনন্দ হলো আমার, পিওন কাকুর কাছ থেকে চিঠি টা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই খুলতে যাচ্ছিলাম,
----মা বললো, উহুঁ, এখন না। স্কুল থেকে ফিরে তারপরে খুলো চিঠি টা। নীল রঙের এনভেলপ এর পেছনে দেখলাম, পেন দিয়ে লেখা, সুবীর সেনগুপ্ত, গোবরডাঙ্গা, উত্তর ২৪ পরগনা।
মনে মনে এবার নিশ্চিন্তই হলাম, হ্যাঁ আমার সেই পত্রবন্ধু কে লেখা চিঠির জবাব এসেছে। খুব খুশি হয়ে ইস্কুলে চলে গেলাম আমি।
**************************************************************************
ইস্কুল থেকে ফিরেই হাতমুখ ধুয়ে মায়ের কাছে সকালের আসা চিঠি টা চাইলাম।
---- মা বলল খেয়ে নে, দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করেই মায়ের কাছ থেকে চিঠি টা নিয়ে খুললাম।
তাতে লেখা ছিল,
----প্রিয় অনুরূপা,
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার লেখা চিঠির উত্তর দিতে দেরি হবার জন্য।
আমার নাম তো তুমি জানোই। আমি গোবরডাঙ্গায় থাকি। তুমি লিখেছো তুমি ক্লাস ৫ এ পড়ো, আমি কিন্তু তোমার থেকে বেশ অনেকটাই বড়।
আমি এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবো। তুমি লিখেছো তুমি গান করো, আমাকে লিখো তোমার প্রিয় গান কি? আমিও খুব ভালোবাসি গান গাইতে। আমাদের ইস্কুলের কোনো ফাংশন থাকলে আমি গান গাই।
তবে আমার ভালোলাগে অন্যরকমের কিছু গান, তুমি কি সলিল চৌধুরীর গান শোনো? না আমি সিনেমার গানের কথা বলছি না। আমি বলছি ওনার যেসব গণসঙ্গীত আছে সেই গান গুলো তুমি শুনেছো? না শুনে থাকলে শুনে দেখো। আর আমাকে অবশ্যই জানিও তোমার কেমন লাগলো সেইসব গান।
মন দিয়ে পড়াশোনা করো, ভালো থেকো। তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকবো।
পুনশ্চ: বন্ধু মানে কিন্ত, শুধুই বন্ধু, আমি তোমার থেকে বড় হলেও, তুমি আমাকে নাম আমাকে নাম ধরেই ডাকতে পারো।
ইতি
তোমার পত্রবন্ধু
সুবীর।
চিঠি পড়া শেষ করেই বাবার কাছে ছুঁটে গেলাম, বললাম বাবা তুমি সলিল চৌধুরীর গান শুনেছো?
বাবা বলল কেন তুই বুঝি শুনিস নি? এই যে রোজ সকালে রেডিও তে গান হয়, সেখানে তো প্রায়ই সলিল চৌধুরীর গান হয়।
আর এই যে আমি আমার টেপ রেকর্ডারে সলিল চৌধুরীর গান বাজাই। তুই তো শুনেছিস সেইসব গান।
আমি বাবাকে বললাম, আচ্ছা বাবা গণসংগীত কাকে বলে?
"পথে এবার নামো সাথী", "ঢেউ উঠছে করা ছুঁটছে", "ও আলোর পথযাত্রী", "হেই সামালো ধান হো কাস্তে টা দাও শান হো"।
আমিও সেদিন বিকেলের খেলা ভুলে বাবার পাশে বসে মন্ত্রমুগদ্ধর মতো সেইসব গান শুনতে লাগলাম।
প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে মা এসে বলল, ----এই যে বাবার আদরের দুলালী, আর কতক্ষন? এবার হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসা হোক।
আমি মায়ের কথা মত পড়তে বসে গেলাম। কিন্তু বারবার মন টা আজ চলে যাচ্ছিলো, বাবার বলা কথা গুলোর দিকে।
পড়া শেষ করে আমি বাবার কাছ থেকে আরেকটা পোস্টকার্ড চেয়ে নিয়ে, সুবীর দা কে চিঠি লিখতে বসলাম।
সে যতই আমাকে বলুক নাম ধরে ডাকতে, আমি কেমন করে তাকে নাম ধরে ডাকি! সে বলে আমার থেকে কতো বড় বয়েসে।
প্রিয় সুবীর দা,
-----তোমার চিঠি পেয়েছি, আমি তো ভেবেছিলাম বোধহয় তুমি আমার চিঠির উত্তর ই দেবে না। জানো আজ সকালে ইস্কুল যাবার সময়, পিওন কাকু এসে আমাকে ডেকে বলল, আমার নাম নাকি চিঠি এসেছে। তারপর ইস্কুল থেকে ফিরে তোমার চিঠি পড়লাম। জানো, আমার বাবাও সলিল চৌধুরীর গান শোনে। আমাদের বাড়িতে একটা টেপ রেকর্ডার আছে, তাতে বাবা কতরকম সব গান বাজায়। আমি সলিল চৌধুরীর গান শুনেছি, আমার খুউব ভালো লেগেছে। কিন্তু জানো তো, মা খালি সরগম করতে বলে, রোজ রোজ ওই সা রে গা মা করতে ভালো লাগে তুমিই বলো তো? এবার থেকে ভাবছি অন্য গানও শিখবো। তোমার ইস্কুল কেমন চলছে? তোমার তো সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা, সেই পরীক্ষা খুব কঠিন হয় তাই না? তুমি আমাদের মোহনপুরে এলে, তোমাকে আমাদের এখানকার গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবো। এখানে খুব ভালো মিষ্টি পাওয়া যায়। তুমি এলে তোমাকে খাওয়াবো।
ইতি
তোমার পত্রবন্ধু
অনুরূপা।
**************************************************************************
এইভাবেই চলতে লাগলো, আমার পত্রবন্ধু সুবীর দার সাথে, আমার চিঠির আদান প্রদান। আমি জানতাম, প্রত্যেক মাসে ২ টো করে চিঠি আমার নামে আসবেই। এই চিঠির মাধ্যমেই আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, সুবীর দা মানুষ টাকে। সুবীর দা, সুপারহিট মুকাবিলা বা চিত্রহার দেখে না।
সুবীর দা অনেক বই পড়ে , গল্পের বই এর পাশাপাশি, সুবীর দা আরো নানান ধরণের বই পড়ে। মাঝে মাঝে চিঠি তে, সুবীর দা ওর পড়া সাম্প্রতিকতম বই যে পড়েছে, সেই বিষয়ে লিখতো আমাকে। আমিও মুগ্ধ হয়ে পড়তাম ওর লেখা চিঠি গুলো। কত অল্প বয়েসেও দেশ বিদেশ সম্পর্কে ওর জ্ঞান থেকে আমি অবাক হয়ে যেতাম!
জীবনের কিছু মুহূর্তের জন্মক্ষণ কে নিয়েই বোধহয় একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। সুবীর দা কে আমি কখনও দেখিনি। কোনোদিন দেখা হবে কিনা তাও জানি না। ও এখন কলেজে যাচ্ছে। কলকাতার ই একটি নামী কলেজে ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে গ্রাডুয়েশনে ভর্তি হয়েছে। ওর এখন অনেক নতুন বন্ধু ও হয়েছে, কিন্তু তাও আমাকে সুবীর দা, আজও ভোলে নি। এখনো নিয়মিত আমাকে চিঠি লেখে। আমার পড়াশোনার খোঁজ নেয়, নতুন কি গান শিখেছি, নতুন কি বই পড়লাম সেইসব কিছু জানাতে হয় আমাকে চিঠিতে।
আমার যখন ক্লাস ৮ হলো, সুবীর দার অনুরোধেই আমি পড়লাম, সমরেশ মজুমদারের লেখা গল্প, উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ। এই বই গুলো পড়তে পড়তে কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম। বুঝতাম একটা সুস্থ সমাজ গড়ে ওঠার জন্য, দরকার হয় কিছু সুস্থ শিক্ষিত মানসিকতার মানুষ দের। সমাজের চারপাশের ছড়িয়ে থাকা চাকচিক্য কে অনায়াসে যারা দূরে সরিয়ে ফেলতে পারে। যারা এই সমাজের বুকে ঘটে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে জানে।
সুবীর দা চিঠিতে আমাকে লিখত, অনুরূপা জীবনে যাই করো, কোনোদিন অন্যায় কে প্রশ্রয় দেবে না। তোমার আশেপাশে যেখানে অন্যায় হতে দেখবে, তুমি তোমার বুদ্ধি দিয়ে, তোমার শিক্ষার বোধ দিয়ে প্রতিবাদ করবে। কখনও অন্যায়ের সাথে আপোস করবে না। সুবীর দা আরও একটা কথা আমাকে বলতো, বলতো অনুরূপা, জানবে এই সমাজের প্রত্যেক টি মানুষের তার সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। একজন রাষ্ট্র নেতার যেমন তার রাষ্ট্রের মানুষ দের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে, তেমনই একজন শিল্পী, একজন সাহিত্যিক, একজন চিত্রপরিচালক, সর্বোপরি আমাদের ছাত্র ছাত্রী আমাদের সবার কিন্তু আমাদের এই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে।
একজন মানুষ কে, সঠিক ভাবে চেনা যায়, তাঁর লেখনী'র মাধ্যমে। আমিও এই কয়েক বছরে, সুবীর দা'র চিঠির মধ্যে দিয়েই, মানুষ টাকে চিনে ফেললাম।
হঠাৎই প্রায় ৩ মাস হয়ে গেলো, সুবীর দার কোনো চিঠি আসে না! প্রথম প্রথম অবাক লাগছিলো, আজ পাঁচ বছর এর মধ্যে এমন একটা মাস যায় নি, যে সুবীর দা আমাকে চিঠি লেখেনি। তাহলে আজ কি এমন হলো তাঁর, আমি পর পর চিঠি লিখে জানতে চাইলাম, তোমার কী হয়েছে? কেন তুমি চিঠি লিখছো না আমাকে? তুমি কি তোমার পত্রবন্ধু কে ভুলে গেলে সুবীর দা? অনেক রকম দুশ্চিন্তা মাথাতে আসতে লাগলো। সুবীর দা ভালো আছে তো? ওর কিছু হয় নি তো?
আমি আমার গ্রামের গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করেছি, পাড়ার বন্ধু ব্যতীত অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে কোনোদিনই আমার সেই অর্থে বন্ধুত্ত্ব হয় নি।
আমিও ইতিমধ্যে ক্লাস টেন পাশ করেছি। আসলে এই ক বছরে সুবীর দার সঙ্গে আমার এই চিঠির মাধ্যমে গড়ে ওঠা, এক অলীক সম্পর্কের সুতোয় কখন যেন নিজেকে বেঁধে ফেলেছিলাম, নিজেরই অজান্তে। হয়ত মনে মনে সুবীর দাকে ভালোও বেসে ফেলেছিলাম।
সুবীর দার বোধ, ওর চিন্তা ধারা, সমাজ সম্পর্কে ওর উন্নত মানসিকতা আমাকে মুগ্ধ করতো। সুবীর দা বলতো, যদি কখনও কোনো কিছুর পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে সবার আগে, নিজেকে নিজের মন কে, প্রসার করতে হবে।
সেই সুবীর দা, হঠাৎই কেমন করে হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে! প্রায় এক বছর ধরে আমি তাকে, নিয়মিত চিঠি লিখে গেছি। বারবার একই কথা জানতে চেয়েছি, তুমি ভালো আছো তো? শুধু এইটুকু আমাকে জানিও। কিন্তু নাহঃ, আমার সেই চিঠির আর কোনো জবাব আমি পাই নি।
ফাগুন হয়ত সবার জীবনেই একই সময়ে আসে। কিন্তু সেই ফাগুনের হাওয়া হয়ত সবার জন্য প্রেমের রঙ নিয়ে আসে না!
কিছু রঙ সারাজীবন ধরেই একটা ফাঁকা ক্যানভাসের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। তেমনই এক অনন্ত অপেক্ষায়
রোজ সকালে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, ভেবেছি আজ হয়ত পিওন কাকু আমার নাম ধরে ডাকবে। কিন্তু আমার সেই আশাও মিথ্যে হয়েছিল।
সুবীর দার চিঠি আর কোনোদিনও আমার কাছে আসে নি!
**************************************************************************
আজ দশ বছর বাদে আমি আমাদের বর্ধমানের বাড়িতে ফিরছি। বিশ্বভারতী থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর লাভ করে আমি চলে যাই, ইউরোপের একটি উনিভার্সিটি তে, উচ্চশিক্ষা র জন্য। এর মাঝে মাত্র একবারই আমি দেশে গিয়েছিলাম। উচ্চশিক্ষার পড়ার চাপ, এর থেকেও যে বিষয় টি আমার দেশে যাওয়ার পথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা হলো আমার বিয়ে নিয়ে আমার বাবা মায়ের অন্তহীন চিন্তা। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালী ঘরের একমাত্র মেয়েকে সুপাত্রস্থ করাটাই বোধহয়, তার বাবা মায়ের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমার ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম হয় নি।
কোনোভাবেই বুঝিয়ে যখন আর আমি পারলাম না, একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি নিজেও জানতাম না, আমি কেন বিয়ে করতে চাইছি না!
এখানকার উনিভার্সিটি তে আমার খুব ভালো দুজন বন্ধু হলো, নিধি আর সাম্য। আমরা সবসময় একসাথেই থাকতাম। আমি বুঝতাম, সাম্য আমাকে মনে মনে ভালোবাসে, কিন্তু কখনোই তা প্রকাশ্যে বলে নি আমাকে। হয়ত এইসব প্রেম ভালোবাসার প্রতি আমার একপ্রকার উদাসীনতা দেখেই, সাম্য সাহস করে আমাকে কখনো কিছু বলে উঠতে পারে নি।
আমার মন খারাপ, আমার দুঃখ গুলো যেন একান্তই আমার নিজের ছিল। মন খারাপ হলে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। পড়ন্ত বিকেলের মায়াবী রোদ, যখন এসে আমার কপাল ছুঁয়ে যেত, সেই আলোর বিন্দু ধরে ধরে আমিও যেন পৌঁছে যেতাম সাগর পাড়ের কোনো একটি এমন জায়গায়, যেখানে আরেকটি নিঃসঙ্গ আলোর বিন্দু আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমার সেই মনের ক্যানভাসে আঁকা সেই দৃশ্যের অস্তিত্ব একসময় ধূসর হয়ে আসতো!
পড়ার পাশাপাশি আমি কিছু বই লিখেছি, সাউথ এশিয়ান সমাজে রাজনীতির প্রভাব এই বিষয় নিয়ে আমার লেখা কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
সাম্য, নিধি আর আমার কাজ , লেখালিখি এই নিয়েই চলছিল আমার দিন যাপন। হঠাৎই বাবা র অসুস্থতার খবর আসে, আর সেই শুনে আমি থাকতে পারলাম না।
আজ আমি দেশে ফিরছি, আমার সেই গ্রামের বাড়িতে, যেখানে আজ থেকে অনেক বছর আগে, কোনো এক পিওন কাকু আমার বাড়ির সামনে এসে আমার নাম ধরে ডাকতো।
আমার সুবীর দার চিঠি আসতো। মনের ভেতরে জমে থাকা, একরাশ অভিমান কে যত্ন করে আগলে রেখে, আজ সেই গ্রামে আমি আবার ফিরছি।
**************************************************************************
এয়ারপোর্ট এ আমাকে নিতে এসেছিলো, আমার মামাতো বোন অপর্ণা আর ওর বর। অপর্ণা আমার থেকে মাত্র ২ বছরের ছোট। ওর বিয়ে হয়েছে চার বছর হতে চলল, ওর মেয়ের বয়েস আড়াই বছর। ছেলেবেলায় অপর্ণা ছিল আমার খেলার সাথী। আমরা একসঙ্গে রান্না খেলনা বাটি খেলতাম
আমার সেই বোন আজ স্বামী মেয়ে নিয়ে নিজেই সত্যিকারের সংসার করছে। ওদের বিয়েতেও আমার আসা হয়নি। এতবছর বাদে ওকে দেখে ভীষণ আনন্দ হলো। সারাটা রাস্তা আমরা গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলাম বাড়ি তে।
বাবার শরীর টা সত্যিই খুব খারাপ হয়েছে। চেনা কিছু বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলে বাবাকে নিয়ে কোলকাতায় বড় ডাক্তার দেখাতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এতবছর বাদে বাবা আমাকে তাদের কাছে পেয়ে, তাদের আবেগ আর ধরে রাখতে পারলো না। একই সাথে আনন্দ আর দুঃখ দুই এসে ধরা পড়লো তাদের কাছে।
দুটো দিন বাড়িতে রেস্ট নিয়ে, বাবাকে নিয়ে ডাক্তার দেখতে এলাম কলকাতার একটি নামকরা হসপিটালে। যথা সময় বাবার নাম ধরে ডাকতে আমরা পৌঁছে গেলাম ডাক্তারের চেম্বারে। দরজায় বড় বড় করে লেখা আছে, ডক্টর: সুবীর সেনগুপ্ত। নাম টা পড়েই আমার বুকের ভেতর টা কেমন করে উঠলো।
আমি সুবীর দাকে কখনও দেখনি। জানি না তাকে কেমন দেখতে। তারও যে নাম ছিল সুবীর সেনগুপ্ত। কিন্ত আমার সুবীর দা তো ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশনা করেছিল। ও তো কখনও ডাক্তার হতে চায় নি।
সুবীর দা বলতো, এই পৃথিবীতে আমি পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দের কাছে কোনদিন দাস হয়ে থাকবো না। যে দেশের শাসন ব্যবস্থা শুধুমাত্র সেই দেশের নেতা মন্ত্রীদের পেট ভরা ছাড়া আর কিছু করে না, যেই দেশের আশি শতাংশ মানুষ, দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না, পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যাবস্থা নেই। প্রকৃত শিক্ষা নেই। আমি সেই সমাজের সমাজপতিদের দাস হয়ে কোনোদিন বাঁচতে পারবো না। সুবীর দা আরো বলতো, নিজের আর নিজের সংসার কে বাঁচানোর তাগিদে, আমি কোনোদিনও এইসব ভোগবাদীদের পায়ের তলার পোকা হয়ে বাঁচতে পারবো না অনুরূপা। সুবীর দা স্বপ্ন দেখত এমন একটা সমাজের, যে সমাজে সব স্তরের মানুষ সমান ভাবে, শিক্ষা পাবে, চিকিৎসা পাবে, সুস্থ সংস্কৃতি নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবে।
বাবাকে ডাক্তার দেখানোর পর, আমি মনে মনে খানিকটা হলেও নিশ্চিত হলাম, নাহ এই ডাক্তারটি আমার সুবীর দা হতে পারে না। অসম্ভব প্রোফেশানাল এই ডাক্তারটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কোথাও বলেননি। বাবার কিছু টেস্ট উনি লিখে দিলেন, বললেন ভয়ের কিছু নেই। সময়মত চিকিৎসা আর ওষুধে বাবা সুস্থ হয়ে যাবে।
খানিকটা আশ্বস্ত হয়েই বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমি। বাড়ী ফিরে মাকে সব বলে, আমি গেলাম আমার ঘরে।
আমার পুরোনো আলমারির দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেক্ষন ধরে। আমার শিশুমন যেন অনেকদিন আগের হারিয়ে যাওয়া কোন রূপকথা কে খুঁজে পেতে চাইছে এই বন্ধ আলমারির ভেতর থেকে। আলমারির ভেতরে একটা বাক্সের ভেতর আমি সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম আমার এতকালের চেনা সেই গভীর অনুভূতি গুলো। আমি বাক্সটা বের করে আনলাম। বুকের ভেতরে আটকে থাকা একরাশ অভিমান যেন জমে জমে একটা পাহাড় হয়ে উঠেছে।
সেই পাহাড় কে ডিঙিয়ে আমার মনের ইচ্ছে আমাকে দিয়ে সেই বাক্সটিকে খোলালো।
বাক্সের ভেতরের সেই ভীষণ চেনা গন্ধ আমার নাকে এসে পৌঁছলো। আমার ভেতরে এতদিনকার জমে থাকা শিশির বিন্দু গুলো যেন বরফ হয়ে গলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। একটা চিঠি বের করে নাকের সামনে ধরলাম। আহঃ কতদিনের সেই চেনা গন্ধ, আমার সমস্ত শরীর জুড়ে যেন এক অচেনা বিদ্যুৎ বয়ে গেলো। একটা একটা করে সুবীর দার লেখা সেই সব চিঠি আবার আমি পড়লাম।
**************************************************************************
আজ রাতেই আমি মনস্থির করেছিলাম, একবার শেষ চেষ্টা আমি করবো। সুবীর দার চিঠির পেছনে, ওর বাড়ির ঠিকানা দেওয়া থাকতো। আমি ঠিক করলাম আমি গোবরডাঙ্গা যাবো, খুঁজে বের করবো সুবীর দার বাড়ি। চাঁদের আলো সমুদ্রে এসে পরে, তাই সমুদ্রের জল কে রাতের বেলায় এতো উজ্জ্বল দেখায়। তাতে তো সমুদ্রের কোনো কৃতিত্ব নেই। আমি আমার মনের মানুষ কে আমার মনের অন্তরস্থলেই লুকিয়ে রেখেছি, কেউ তাঁর খোঁজ জানে না, এমনকি আমিও না। আমি যা খুঁজে চলেছি, তা কেবল আছে একজনেরই কাছে। আমিই যদি তাকে না খুঁজি, তাহলে তো আমার এতদিনের দেখা স্বপ্ন সব মিথ্যে হয়ে যাবে! আর যদি সবকিছু মিথ্যেও হয়ে থাকে, তাহলে একবার, শেষবারের মতো চেষ্টা করব। দরকার হলে তার সামনে গিয়ে বলব, আমার এতদিনের জমা অভিমানের ঋণ শোধ করতে এসেছি।
সেইমতো বেড়িয়ে পড়লাম, আমার হারিয়ে যাওয়া রূপকথার মানুষ টাকে খুঁজতে। বর্ধমান থেকে সোজা ট্রেনে করে, শিয়ালদহ। সেখান থেকে আবার একটা ট্রেন পাল্টে পৌঁছে গেলাম গোবরডাঙ্গা বলে একটি জায়গায়। মোবাইলে গুগল ম্যাপে সুবীর দার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেখলাম, স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে বড়জোর ১০মিনিটের রাস্তা। স্টেশনের বাইরে অনেক রিক্সা দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু আমি কী ভেবে হাঁটতে শুরু করলাম। হয়ত আমার ভেতরে এতদিনকার লুকিয়ে থাকা স্বপ্ন গুলোকে এই গোবরডাঙার রাস্তায় খুঁজে পেতে চাইলাম, রাস্তার ধুলোপথে হাঁটতে হাঁটতে, চিনতে চেষ্টা করলাম আমার খুব চেনা এক মানুষকে।
গুগল ম্যাপ দেখে যখন নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে আমি পৌঁছলাম, তখন আমার মনের ভেতরে অজস্র ঢেউ যেন সশব্দে আছড়ে পড়ছে, আর আমি যেন সেই ঢেউ ভাঙার প্রত্যেকটি শব্দ কে অনুভব করতে পারছি। অনেক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া একটা স্বপ্ন! সেটা কি সত্যি ছিল?
আজ তাকে আমি প্রত্যক্ষ করতে এসেছি। আমি জানি না আমার সেই বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া সেই স্বপ্নের মানুষটাকে আমি আবার আগের মতো করে পাবো কি না! হয়তো সে আজ বিবাহিত, হয়ত সে আজ স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে ঘর করছে।
আমার সব ভাবনা গুলো অতীত থেকে বর্তমানে এসে যেন চক্রবুহ্যের মতো আমার সামনে ঘুরতে লাগলো। ফেলে আসা অতীত আর আজকের দিনের মাঝে এক বিরাট বড়ো সাঁকো তৈরী হয়েছে। সেই সাঁকো বেয়ে আমি পৌঁছতে চাইছি আমার ফেলে আসা অতীতে।
-----কাউকে খুঁজছো মা? হঠাৎ একটা ডাক শুনে আমার সম্বিৎ হলো। দেখলাম আমার মায়ের থেকে বয়েসে কিছুটা বড় একজন প্রৌঢ়া এসে দাঁড়িয়েছেন বারান্দায়। তিনি যে একসময় অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন, সেটা না বলে দিলেও চলবে। আমি নমস্কার করে বললাম, মাসিমা আমি অনুরূপা।
সুবীর সেনগুপ্ত কি এই বাড়িতেই থাকে?
আমার নাম শুনে ভদ্রমহিলার মুখে এক অপার্থিব আনন্দ যেন বয়ে নিয়ে এলো। তুমিই সেই! বসো মা বসো।
স্বপ্নকে প্রকৃত অর্থে ব্যাখ্যা করতে আমরা কেউই পারি না। কারণ স্বপ্ন আমরা আমাদের অবচেতনে দেখে থাকি, আর সেই অবচেতন মনের দেখা স্বপ্নের রাস্তা ধরে আমি তো বহুদিন আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম এই বাড়িতে। যেখানে মনে মনে একটা সংসার তো সেই কবেই বেঁধেছিলাম আমার সুবীর দার সঙ্গে।
আমার সেই সংসার কে আমিই বুকের ভেতর সযত্নে আগলে রেখে দিয়েছিলাম এতবছর ধরে।
উনি আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি দেখলাম, সারা ঘর জুড়ে অজস্র বই এর সংগ্রহ। বাংলা সাহিত্য থেকে, বিদেশী লেখকদের নানান ধরণের বই সেখানে রাখা আছে। আমি ঘরের ভেতর সেইসব বই দেখছিলাম, হঠাৎই আমার নজরে পড়ল একটি বই তে। আজ থেকে দু বছর আগে, আমার লেখা সাউথ এশিয়ান জনজীবনে রাজনীতির প্রভাব নিয়ে একটা বই প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও আমাদের দেশে খুব বেশি বই টি বিক্রি হয় নি। আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম এখানে আমার বই টি দেখে।
---আমি বললাম, মাসিমা সুবীর দা?
উনি বললেন, তাকে তো এইসময় বাড়িতে পাওয়া যাবে না মা। তুমি কি অপেক্ষা করবে? নাকি আমি তোমাকে বলে দেব সে কোথায় আছে?
জীবনে প্রথমবার তাঁকে দেখবো আমি! সারা রাত এতদিন ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা শিশির গুলো গলেছে। এতবছর ধরে সেই জল কে পরম যত্নে মুছিয়ে দেবার মতো কেউ ছিল না।
আমি আর অপেক্ষা করতে পারবো না মাসিমা। বলেই কেমন সংকোচ হলো, উনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন।
আচ্ছা মা, আমি শিউলি কে তোমার সঙ্গে দিচ্ছি, সেই তোমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে সুবীরের কাছে।
সুবীর দার বাড়িতে কাজ করে বোধহয় মেয়ে টি, হাসিখুশি স্বভাবের মিষ্টি মেয়ে শিউলি এসে আমাকে বললো দিদি চলো আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি মাস্টার দাদার কাছে। সারাটা রাস্তা মেয়েটার সাথে কথা বললাম, ও ক্লাস ৯ এ পড়ে। ওর কথা শুনে বুঝতে পারলাম অসম্ভব মেধাবী মেয়েটি। দেশ বিদেশ সম্পর্কে বেশ ভালোই জানে ও।
কথা বলতে বলতে আমরা এসে পড়লাম একটি মাঠের কাছে, সেখানে দেখলাম একটা গাছের সামনে অনেক বাচ্চা রা শতরঞ্চির ওপর বসে আছে, তাদের কে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তারা এই গ্রামে বসবাসকারী অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা সব শিশুরা। আমি অবাক হয়ে দেখছি ওদের, ওরা কেউ কোনো গোলমাল করছে না, কেউ কথা বলছে না, সবাই ব্যস্ত নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে। ঠিক যেন একটা পবিত্র আশ্রম।
আমি শিউলি কে বললাম, --কোথায় তোমার দাদা? ও আমাকে আঙ্গুল দিয়ে সোজা গাছের নিচে দেখিয়ে বলল, --কেনো ওই তো আমার মাস্টার দাদা বসে আছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ না?
আমি দেখলাম, গাছের নিচে একটা হুইল চেয়ার এ বসে আছে, এক অতি সুদর্শন যুবক। মানুষ একা ঘরের ভেতর থাকলে নিজের হৃদপিণ্ডের শব্দ নিজে শুনতে পায়। আমি ঠিক এই মুহূর্তে আমার নিজের হৃদস্পন্দন আমি শুনতে পাচ্ছি। এতকালের অদেখা সেই স্বপ্নের মানুষ টা, আজ আমার সামনে!
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে, আমি এগিয়ে গেলাম তাঁর কাছে। দিনের সূর্য্য তখন মধ্যগগনে। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আমার ছায়া গিয়ে পড়ল তার মুখে।
বই থেকে মুখ তুলে সে তাকালো আমার দিকে।
নিজের অজান্তেই কখন যে চোখের কোনে জল এসে বসেছিল তা আমি টেরও পাই নি। শেষ পর্যন্ত এই মুহূর্ত টাতে আমি পৌঁছতে পারবো কিনা আমার জানা ছিল না! আমার এতদিনকার সব অভিমান, দ্বিধা দ্বন্দ কে জয় করে আমি আজ আমার স্বপ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
--বললাম, আমাকে তুমি চিনতে হয়তো পারবে না। তাই কিছু সঙ্গে নিয়ে এসেছি, যদি এগুলো দেখে কিছু মনে পরে।
বলে ব্যাগ থেকে বের করলাম, আমাকে লেখা সুবীর দার সেইসব চিঠি গুলো। ওর হাতে দিয়ে বললাম, দেখো তো এগুলো চিনতে পারো কিনা?
আমার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল ও। তারপর শিউলি কে বলল একটা চেয়ার এনে দিতে।
আমাদের জীবনে এক একটা সময় এমন আসে, যখন অনেকদিন ধরে কষে চলা অঙ্ক গুলোও যেন ভুল হয়ে যায়।
সুবীর দা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল।
---আমি বললাম, চিনতে পারছো আমাকে?
----সুবীর দা বলল, তোমায় কী করে ভুলি অনুরূপা?
আমার বুকের ভেতরে যেন সেই মুহূর্তে কোন পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে নেমে আসা এক জলস্রোতের শব্দ আমি টের পেলাম!
------কেন তুমি এতগুলো বছর নিজেকে আমার কাছ থেকে আড়াল করে রাখলে? আমার এতদিনকার জমে থাকা সমস্ত অভিমান যেন ঝরে পড়লো আমার কথাতে।
------সুবীর দা বলল, আমি জানি তোমার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো পথ খোলা নেই অনুরূপা। কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এটা দেখে এতবছর বাদেও তুমি আমার কথা মনে রেখেছো! আমার ঠিকানা নিয়ে আজ আমাকে খুঁজতে এসেছো তুমি!
-----অনুরুপা, আমার আজকের অবস্থা তুমি তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ। আমি যখন এম.এ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, সেই সময়কার ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনায় আমার একটি পা আমি হারিয়ে ফেলি। উনিভার্সিটির এক বড়লোকের ছেলে আর তার দলবল নিয়ে আমাদের ব্যাচের কিছু মেয়ে দের সাথে অন্যায় আচরণ করেছিল। আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ফল হলো, একদিন রাতে হোস্টেলের ঘরে ঢুকে, ওরা আমাকে প্রচন্ড মার্ মেরেছিলো। হকি স্টিক, ছাড়াও আরো বেশ কিছু ভারী জিনিস দিয়ে ওরা আমাকে এমনভাবে মেরেছিলো, তিন পর যখন হসপিটালে আমার জ্ঞান ফিরলো, আমি বুঝতে পারলাম, আমার চলৎশক্তি আমি হারিয়েছি!
সমাজের প্রভাবশালী বাবার ছেলে হওয়ার ফল স্বরূপ, সেই অমানুষ গুলোর কোনো শাস্তিই হয়নি। তারা আজও এই সমাজের বুকে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
------তোমার যে সুবীর দা, তোমাকে চিঠিতে সবসময় বলতো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, কিন্তু সে নিজেই তো তার নিজের জীবনের চলার পথে হেরে গেলো, অনুরূপা। আমি কি মুখ নিয়ে তোমাকে সেই কথা জানতাম বলতে পারো তুমি? আমি যে আমার কথা রাখতে পারিনি।
আমি সুবীর দার পায়ের কাছে বসলাম। ওর হাত দুটো ধরে বললাম, -- আমি অনেক দূর থেকে তোমার কাছে এসেছি সুবীর দা, আমাকে আজ তুমি কিছুতেই ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
এতগুলো বছর ধরে, আমি পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে বসে সেই আকাশের মধ্যে তোমার আকাশকে খুঁজে গিয়েছি!
খুঁজতে খুঁজতে আজ আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি গো। তুমিহীন আমার এই জীবনকে একা বয়ে নিয়ে চলা, আর আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
একটুখানি জায়গা দেবে তোমার পাশে?
তুমি যেমন তেমনভাবেই থাকবো তোমার পাশে। বলেই আমার ভেতরের জমে থাকা সব অভিমান ঝরে পড়লো অঝোর ধারায়।
---সুবীর দা আমার মাথায় হাত রেখে বলল। জানো অনুরূপা, এতদিন ধরে আমি কেবল একটা বিন্দু দেখে যাচ্ছিলাম, সেই বিন্দু কে টেনে নিয়ে একটা বৃত্ত কে সম্পূর্ণ করার মতো স্পর্ধা বা মনের জোর কোনোটাই আমার ছিল না।
---আমি বললাম, সব ভুলে যাও, মনে করো এতদিন কোনো এক অজানা পৃথিবী তে তুমি ছিলে, আমিও নিঃসঙ্গ ছিলাম অন্য কোনো এক গ্রহে। আজ হঠাৎই কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আমাদের কে দুটি গ্রহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে এসেছে, এই পৃথিবী তে। আর তোমার সেই বিন্দু কে, একটা সম্পূর্ণ বৃত্ত তৈরী করব বলে আমি এসেছি।
সুবীর দা বলল, ----- এই দেখো, এই সব ছোট ছোট ফুলের মতো শিশুদের কে, আমি পড়াই। স্কুলের বই এর পাশাপাশি ওদের কে আমি জীবন গড়ার পাঠ দিই।
তুমি পারবে অনুরূপা, আমার সঙ্গে থেকে ওদের পাশে থাকতে?
আমি সেই মাঠের একদম শিশুদের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার অন্য পৃথিবী তে আমি এতদিন ধরে নিজের মনের তুলি দিয়ে নানারঙের স্বপ্ন বুনেছি।
আজ আমার চোখের সামনে সেইসব স্বপ্ন কে আমি সত্যি হতে দেখছি।
**************************************************************************
বিকেলের পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে আমাদের বারান্দায়, সেই গোধূলির আলো গায়ে মেখে, সুবীরের পাশে বসে গান ধরলাম।
"যা চেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে
দুহাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতন হেসে।
খুঁজতে যারে হয় না কোথাও, চোখ যেন তাই দেখে,
সদাই যে রয় কাছে, তারই পরশ যেন ঠেকে।
নিত্য যাহার থাকি কোলে, তারেই যেন যাই গো--- বলে,
এ জীবন ধন্য হলেম তোমায় ভালোবেসে।
ভুলাগড়ের রাজা
Ranjan Banerjee
Germany

ভুলাগড়ের জনগণ দুশ্চিন্তায়। সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধির জীবনে, রাজা অসুস্থ হলে দুশ্চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। অসুখটাও অন্যরকম। রাজা নাকি সবকিছুই ভুলে যাচ্ছেন। গোপন সূত্রানুযায়ী, সপ্তাহখানেক আগে রাণীর সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যালাপের পরেই, রাজার স্মৃতিভ্রংশের সূচনা।
রাজার স্মৃতিভ্রংশের কিছু উদাহরণ জনসমক্ষে প্রকাশ পেয়েছে। খাওয়ার সময়, হাতের খাবার মুখে পুরতে ভুলছেন। স্নানঘরে স্নান ভুলে, গায়ের পরিবর্তে জল মাটিতে ঢালছেন। রাজপরিচয় বিস্মৃত হয়ে, নিজেই বাজারে যাচ্ছেন, শাক-সব্জির দরদাম করছেন। জনগণের অভিবাদনের উত্তরে সবাইকে কুর্নিশ করছেন। আর অস্বাভাবিক কর্মকান্ডের মাঝেই, অপরিচিত কিছু শব্দাবলী শুনতে পাচ্ছেন মানুষজন। কখনো 'ওবাকেআরাহাথেবাঁ', কখনো 'ভবিককিভুক', আবার কখনো 'ঈরাবোকদা' বলে চেঁচিয়ে উঠছেন রাজা। সীমানা বিতর্কে পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে গিয়ে আর এক কান্ড! যুদ্ধ ভুলে, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাকে গোলাপ ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা করে, করুণ সুরে রাজা বলে উঠেছেন, 'তোরাকিআম'। মন্ত্রী, সেনাপতি আর অন্য রাজকর্মচারীরা চিন্তিত - এভাবে চললে দেশের সর্বনাশ! সবাই ব্যস্ত হয়েছেন প্রতিষেধকের সন্ধানে। অপরিচিত শব্দার্থ অনুসন্ধানে পণ্ডিতরা পুঁথি ঘেঁটে-ঘেঁটে ক্লান্ত। কারোর মতে রাজা পূর্বজন্মের অচিন দেশে ফিরে গেছেন। কেউ বলছেন রাজা বোধহয় আবার স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে শুরু করতে চাইছেন। প্রকৃত কারণ এবং সমাধান যদিও এখনো অধরা।
শেষে অনেক প্রচেষ্টায় সফলতা পেয়েছেন রাজবৈদ্য। ব্রাহ্মিশাক মিশ্রিত নতুন ওষুধ খাইয়েছেন রাজাকে। ওষুধের প্রয়োগেই রাজার কুঁচকানো ভ্রূ সোজা হয়েছে। ডাক পড়েছে মন্ত্রীর। দেশে ছড়িয়ে পড়েছে খুশির খবর।
খবর শুনেই রাজসভায় হাজির রাণী। রাজা ভুললেও রাণীর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। থমকে যাওয়া আলোচনার ঠিক শেষ বাক্যেই ফিরেছেন রাণী। রাজার হাতে তুলে দিয়েছেন সীতাহার, হীরের দুল, নাকছাবি, কানপাশা সহ বিভিন্ন গয়নার লম্বা এক তালিকা। সঙ্গে শুরু করেছেন ঘ্যান-ঘ্যানানি, 'বলেছিলে দেবে, এখনো দাওনি।'
রাজার ভ্রূতে আবার ভাঁজ, চোখে ফিরে এসেছে সব ভুলে যাওয়া চাউনি। হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছেন রাজা, 'ওরে বাবা কেউ আমাকে রাণীর হাত থেকে বাঁচা', 'ভগবান বিয়ে করে কি ভুল করেছি', 'ঈশ্বর রাণীকে বোবা করে দাও'।
উপস্থিত এক যুবক ভাষাবিদ হঠাৎ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল, 'পেয়েছি-পেয়েছি, 'ওবাকেআরাহাথেবাঁ', 'ভবিককিভুক', 'ঈরাবোকদা' মানে খুঁজে পেয়েছি।'
অবাক হয়ে, মাথা চুলকে সেনাপতি প্রশ্ন করলেন, 'কিন্তু তোরাকিআম মানে?'
ভাষাবিদের সহাস্য উত্তর, 'তোমার রাণীও কি আমার মত?'
মিথ্যেবাদী
Maitreyee Chakraborty
New Jersey, USA
আমার গাড়ীটা যখন জাতীয় সড়ক থেকে আমার বাড়ীর পথ ধরে, প্রতিবারই, এক ঝাঁকুনিতে আমি পৌঁছে যাই আমার ফেলে যাওয়া জীবনটায়। এখন আমাদের গ্রামটা একটা আধাখ্যাঁচড়া পল্লী। সেখানে অধিকাংশ বাড়ীই মাটির থেকে ইঁটের হয়ে গেছে। পলেস্তারা বা রঙ হয়ত নেই বেশীরভাগেরই, হয়ত ছাদেও টালি বসানো; তবু ‘পাকাবাড়ী’ হয়েছে তারা। এসবের মাঝে বিচ্ছিরি বেমানান হয়ে আমার কাঁচামাটির বাড়ীটা আজও আমার ফেলে যাওয়া দিনগুলোকে ধরে রাখার প্রয়াস চালায়। গাড়ী বাড়ীর সামনে এলে, এখনও সেই গ্রামের মানুষের কৌতুহলের স্বভাব গেলো না। হয়ত সারল্যও এটা। কাজকর্মহীন, আগানে বাগানে নেচে বেড়ানো শৈশব পিছু ধরে আমার গাড়ীর। সাইকেল আরোহী রাস্তার ধারে নেমে এক পা নামিয়ে থমকে দাঁড়ায় জিজ্ঞাসু চোখে। আমি জানি, আজও সেই লোকটাকে দেখব উঠোনে খাটিয়া পেতে বসে রয়েছে, আমায় দেখলেই একগাল হেসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে চোখের জলে ভাসবে। আমি হয়ত প্রতিবারের মতো এবারও ডাকব, “বাজান” আর মিথ্যেবাদী লোকটা বলবেই বলবে “আমি তোর বাজান নই রে মা, তোর বাজান দেবতা ছিলেন দেবতা”।
**************************************************************************
দাওয়ায় বসে ছোট্ট হানিয়া পা নাচাচ্ছে, দাওয়ার এক পাশে তার মা একটা কালো হাঁড়িতে ভাত ফোটাচ্ছে। দু’জনেরই চোখ তাদের কঞ্চির বেড়ার গেটের দিকে। দুপুর ঝাঁঝাঁ করছে মানে এইবারে সেই লোকটা আসবে। এসেই একগাল হেসে, মাথার ঝাঁকা নামিয়ে বেড়ার পাশে রাখা বালতিটা নেবে আর হানিয়া লাফ দিয়ে যাবে। প্রায় রোজই ঘটে একই দৃশ্য। লোকটা হানিয়াদের কেউ নয়। কোনো এককালে, যখন হানিয়া মাত্র কয়েকদিনের শিশু, সে সময়ে হানিয়ার ডাক্তার বাজান এদের গ্রামে গিয়ে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করত আর তারপরে যেন কী সব ঘটেছে, আজও হানিয়ার বাজানকে খুঁজে পায়নি কেউ। ওরা মা-বেটিতে রোজ কামনা করে যেন ফিরে আসে সে।
ঝাঁকা নামিয়ে, এক হাতে বালতি নিয়ে আরেক হাতে হানিয়ার হাত ধরে হানিয়ার মায়ের উদ্দেশ্যে বলবে “জল আনি গে”। তারপর কলর কলর শুনতে শুনতে পাড়ার টিউকলে গিয়ে বালতি ভরে, স্নান করবে। আবার ফেরার পথে এক কাঁধে হানিয়া আর অন্য হাতে এক বালতি জল নিয়ে ফিরবে। টিউকলটা া বড়দের জন্য তেমন দূর নয়, কিন্তু কচিকচি পায়ে হানিয়া ওই অবধি তুরতুর করে গেলেও ফিরতি পথে তার মনেহয় যেন পা ব্যথা করছে। মা দু’একদিন মৃদুস্বরে বলে এটা করতে না; দড়ি পাকানো চেহারার লোকটা তাতে বেশ রাগ রাগ গলায় উত্তর দিয়ে দেয়। তার অমন শক্তপোক্ত চেহারায় এসব যেন তুচ্ছ কাজ। আর তারওপর হানিয়ার মতো পাখির ছানাকে কাঁধে নিয়ে তার কোনো মালুম পড়ে না, অতএব, হানিয়ার মা চুপ করে যায়।
উঠোনের এক ধারে লোকটার সংসার। চারটে বাঁশ পুঁতে তারওপর একটা ত্রিপল গোছের কি জানি টাঙানো আর তার নীচে একটা খাটিয়া পাতা। হানিয়ার মা একটা থালায় গরম ভাত দেয় আর সেদিন যা চাট্টি রান্না হয়েছে তাই। তবে, সামান্য খাবারও খুব আদরের সাথে গুছিয়ে পরিবেশন করে। মাঝেমাঝেই নরম আওয়াজে মা জিজ্ঞেস করে,
”আপনি কি কোনোদিনও দাওয়ায় বসে খাবেন না?”
“বলেইছি তো, মা আমার বড় হোক, সব বুঝুক, দিন তো পড়েই রইলো। আমার দেবতার পরিবারে কালি ছিটোবে মানুষে সে আমি প্রাণ থাকতে হতে দেবো না। উঠোনে থাকি তাইতেই কতো কথা; দাওয়ায় বসলে বলবেই যে, ঘরে ঢুকি। লোকের মুখ বন্ধ রাখতে চেষ্টা তো করতেই হবে। শেষে যদি মা আমার ভুল বোঝেন? তখন?” একটা দীর্ঘ নিশ্বাস শোনে হানিয়া। এই যে লোকটা কাজ সেরে এলো, চান করে ফিরলো এসব সময়ে হানিয়া দেখেছে পাড়ার মানুষের কৌতুহলী উঁকিঝুঁকি। বেশীরভাগ সময়েই লোকটা হাত নাড়িয়ে হুশহুস করে তাড়ায় তাদের। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে পর লোকটা তার ঝাঁকা থেকে বিভিন্ন জিনিস বের করে। শাক-সব্জি, ফল-পাকুড় থেকে শুরু করে নানান মজার খাবার, হানিয়ার জন্য বই, মায়ের কাজের নানান দরকারি জিনিস একেএকে সব দেয়; এই সময়টা হানিয়ার কাছে বড্ড আকর্ষণের। রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে হানিয়া আর ওর মা দরজায় খিল তুলে ঘুমোতে যায়, আর ওই লোকটা বাইরে খাটিয়ায বসে বাঁশি বাজায়। মা চোখের জল মোছে, হানিয়া তারপরে আর জানে না, ঘুমিয়ে পড়ে।
হানিয়া জানে তাদের জীবন আর পাঁচজনের মতো নয়, ছোটো মানুষ ঠিক ধরতে পারে না কোথায় তফাত। তাদের খাওয়া পরা সবই আছে। ঘরের চাল, দেওয়ালে মাটি সব ওই লোকটা আর মাযের নজরদারীতে সময় মতো ঠিক করে নেওয়া হয়। মা কতো সাধারণ জিনিসেও কতো সুন্দর রান্না করে, হানিয়ার মনে কোনো অভাব ছিলো না। লোকটা ঘর ছাইবার দিনে কিন্তু পাড়ার উঁকিমারা জনতাকে তাড়ায় না। সে লোক যে হানিয়াদের ঘরে ঢুকছে না, এটা সবাই দেখে রাখুক সে তাই চায়। নিজে হাতে করে, কখনও কখনও মায়ের সাহায্যও নেয়।
একবার বুঝি তাদের মা-বেটিকে লোকটার এলাকার কোনো উৎসবে নিয়ে গেছিলো। সেখানে মেলাও ছিলো। মেলায় মা নিজের কিছু কিনতে দাঁড়িয়েছে আর লোকটা হানিয়াকে নিয়ে তেলেভাজা না কি কিনছিলো। হানিয়া হঠাৎই দেখে অন্য একটা লোক তাকে ইশারা করে ডাকছে, তার হাতে সুন্দর একটা পুতুল। হানিয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক দু’পা এগিয়েছে কি এগোয়নি তখনই তাদের মাঝে মেলায় ঘোরা আরোও কিছু মানুষ এসে পড়ায় হানিয়া দিক হারিয়ে ফেলে ওইখানে দাঁড়িয়েই হাপুশ নয়নে কাঁদতে থাকে “বাজাব, বাজান” করে। লোকটা যেন কোত্থেকে এক দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে ভীত মেয়েকে। কয়েক মিনিটের ঘটনা কিন্তু হানিয়ার মনে খুব বড় দাগ কাটে। সে এটাই বোঝে তার ‘বাজান’ হলো এই লোকটা আর বিপদের থেকে বুক দিয়ে আগলাবে সে। তারপর থেকেই শুরু তাদের অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা। হানিয়া যখনই ডাকে “বাজান” লোকটা বলবে, “আমি তোর বাজান নই রে মা, তোর বাজান দেবতা ছিলেন দেবতা”।
বেশ কিছুটা বড় হবার পর বোঝে লোকটার নাম হানিয়া জানে না। ওই যখন কাঠখোট্টা লোকগুলো আসে, মা তাকে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে থরথর করে কাঁপে আর কাঁদে; সে সময়ে ওই লোকগুলো বুঝি ‘কেষ্টা’ বলে ডাকে। তাহলে কি এটাই ওর নাম? হবে হয়ত। হানিয়া যেমন তার মায়ের নাম জানে না, লোকটার নাম নিয়েও মাথা ঘামায়নি সে।
মা আর ওই লোকটা দু’জনে দুটো গল্প প্রায়শঃই বলে হানিয়াকে, সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের গল্প হলেও, হানিয়া জানে কোথাও গল্প দুটোর যোগাযোগ আছে। সেটা যে কোথায় তা বোঝে না। মা শোনায় দুঃখী মানুষদের কথা। “অনেক বছর আগে এক ধনীর বাড়ীতে জন্মেছিলো এক ছেলে। ছোটোবেলায় আর পাঁচজন ধনীর সন্তানের মতো কাটলেও বড় হবার পর ছেলেটার কীই যে ঢুকলো মাথায়, সে নাকি শুধু গরীব মানুষদের দুঃখ দূর করবার কাজে ব্রতী হবে। বাবা তাকে বিলেত পাঠালো পড়াশোনা করতে। সেখানে যাতে সে ছেলে আটকে পড়ে আর দেশে না ফেরে তার চেষ্টাও বাবা করেছিলো বৈকি। কিন্তু, সে ছেলে তো সেই ফাঁদে পা দেবার মানুষই নয়। কাজেই ভালোভাবে লেখাপড়া শিখে প্রচুর যশ সংগ্রহ করে সে ছেলে আবার সেই গরীবদের কাছেই ফিরে আসে। একটা বস্তিতে কাজ করতে গিয়ে সেখানে এক অভাগা আনাথিনীকে উদ্ধার করে ছেলেটি। আর এইসব দেখে, ছেলেটির বাবা তাকে মা-বাবা অথবা বিয়ে করা বৌ যেকোনো একদিক বেছে নিতে বলে। ছেলেটির খুব কষ্ট হলেও বিয়ে করা বৌকে নিয়েই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে, বিদায় নিতে হয় বাবার বাড়ী থেকে” মোটামুটি এই অবধি শুনতে পায় হানিয়া, তারপর সে ছেলে কোথায় গেলো বৌকে নিয়ে বা ছেলেটার বাবা-মার কী হলো, কিছুই আর শোনা হয় না। এমন ঘুম জড়িয়ে ধরে প্রতিবার।
আর ওই কেষ্টা নামের লোকটা শোনায় এক ডাক্তারবাবুর কথা, সে নাকি ধন্বন্তরি। ধন্বন্তরি হলো দেবতাদের ডাক্তার। দেবতাদের রোগ সারাতে পারে যে, অব্যর্থ ওষুধ যে দেয়, সে কী সাধারণ মানুষ হতে পারে? তিনিও দেবতাই হলেন তো। তা, সে ডাক্তারবাবু খুব গরীব। একটা অজ পাড়াগাঁয়ে একটা মাটির কুটিরে তার বৌকে নিয়ে থাকেন। বিদেশ থেকে নাকি পড়াশোনা করে এসেছেন, সেখান থেকে কিসের সব টাকা পয়সা আসে তার নামে। তাই দিয়েই তো তার সংসার চলে। তিনকূলে তাদের বুঝি কেউ নেই। সেই ডাক্তারবাবু গরীব মানুষদের শুধু শরীরের চিকিৎসাই করতেন না, তিনি তাদের অধিকার বুঝে নেওয়ার পাঠ দিতেন। তিনি বোঝাতেন গরীর মানুষ বলে আসলে ভগবান কাউকে বানান না, সেটা তাদের ‘কপালের লিখন’ বলে মেনে নেওয়াটা মূর্খামি। তাদের অনেক কিছু সেখাতেন তিনি। তারা সবে বুঝতে শিখছে যে, তাদের প্রাপ্যটা কেউ কৌটয় ভরে এসে দিয়ে যাবে না, সেটা নিজেদের বুদ্ধি, মেধার জোরে অর্জন করতে হবে। তেমন সময়েই ডাক্তারবাবুর সংসারে এক নতুন মানুষ আসে। ডাক্তারবাবুর সাথে বাকি সবাইও খুব খুশী। তারা সেই ছোট্ট মানুষটির যাতে কোনো কষ্ট না থাকে তাই সে ব্যাপারে নজর রাখতে শুরু করে সবাই মিলে, তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী। নতুন মানুষটির নাম রাখা হয় এমন, যার অর্থ হলো সুখী। কিন্তু, ডাক্তারবাবুর কার্যকলাপে কিছু লোভী, স্বার্থান্বেষী মানুষের অসুবিধে হতে শুরু করেছিলো। তার নানা সময়ে নানা ভাবে ডাক্তারবাবু ও তার স্ত্রীকে উত্যক্ত করতে থাকে, হুমকি দেয়। নাহ, কোনো কিছুতেই কাজ হয় না। কারণ, ডাক্তারবাবুর স্ত্রীও ডাক্তারবাবুর মতোই শক্ত মনের মানুষ। তাদের টলাতে পারেনি, কিন্তু ওই ছোট্ট মানুষটার ব্যাপারে সবাইই একটু মানসিক দূর্বলতায় ভোগে; এ তথ্যটা সুযোগসন্ধানী মানুষদের বুঝতে দেরী হয়নি। তাই তাকে সামনে রেখে মানসিক চাপে ফেলে ডাক্তারবাবুদের। একটু অসাবধান হয়েছিলেন বুঝি, একদিন হঠাৎ করেই হারিয়ে যান ডাক্তারবাবু। তারপর? আর এগোয় না গল্প।
একটু একটু করে বড় হয় হানিয়া। কেষ্টা নামের লোকটা তাকে টানতে টানতে ইস্কুলে নিয়ে যায়। সেখানে অবশ্য তার মতোই আর পাঁচটা পয়সা কম ঘরের ছেলেমেয়ে পড়তে আসে, কাজেই হানিয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা গজায় না। মিলেমিশে লেখাপড়া আর অনেকটা জীবনের নানা বিষয়ে শিখে বড় হয় হানিয়া।
তারপর ওই লোকটার উদ্যোগেই কাঁদতে কাঁদতে শহরে পড়তে যায় হানিয়া। লোকটা তাকে বোঝায়, হানিয়া অনেক বড় মাপের মানুষ হবে, সে তার বাজানকে ফিরিয়ে আনবে। আর ততোদিন এই কেষ্টা তার মায়ের পাহারায় থাকবে। হানিয়া বুঝতে পারে না কেষ্টা এখনও পারবে কী করে? তার বয়স বেড়েছে; এখনও তো সে দাওয়ায় ওঠে না ঘরে যাওয়া তো দূর। এখন অবশ্য ঘরে থাকাটা একটু অসুবিধারও কারণ হানিয়াদের বাড়ীতে তো একটা মাত্র ঘর। সে ঘরে এতোটা কাল মা-বেটিতে থেকেছে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা লোকটা কি অদ্ভুত ভাবে ওই ত্রিপল টাঙানো খাটিয়ার মধ্যেই কাটাতো। তবে, কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতো তার মাও নির্ঘুম বসে আছে। হয়ত সেরাতে খুব বৃষ্টি কিম্বা প্রবল শীত। কেষ্টা হানিয়াকে বুঝিয়েছে শহরে হানিয়া একটা বড় দালান বাড়ী বানাবে,যেখানে ওরা মা-বেটিতে আনন্দ করে থাকবে; সেখানে তখন একটা ঘরে কেষ্টা থাকবে। তদ্দিনে যদি বাজানের খবর পায় হানিয়া তবে তো তার নাম সার্থক হবে। হানিয়া প্রকৃতই সুখী হবে। কিন্তু সে সবের জন্য তো শহরে যাওয়া, ভালো করে লেখাপড়া শেখা এবং শক্তপোক্ত একটা কাজের জোগাড় করতে হয়। তা নাহলে হানিয়া সমাজের নোংরা মনের মানুষগুলোর সাথে লড়বেই কী করে আর বঞ্চিত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবেই বা কী করে। যেমন তার বাজান করতেন।
**************************************************************************
সারাটা জীবন আমি ওই লোকটার কথা শুনে চলতে বাধ্য হয়েছি। মা বলতেন, আমাদের বিপদের দিনে ওই লোকটা নাকি ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। বিপদটা আমি কোনোদিনই বুঝিনি, কারণ, আমার সহপাঠীদের অনেকেরই হয় বাবা নয় মা ছিলো না। তাঁরা হারিয়ে গেছেন, মারা গেছেন, ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র, এমন বিচিত্র সব কম্বিনেশন দেখেছি। কাজেই, আমার বাবা নেই বলে আমাদের দারুণ বিপদ বুঝিনি সত্যিই। শহরে পড়তে এসে কিছুটা বুঝলাম। যখন খুঁজে পেলাম আমার বাবার বাড়ীর মানুষজনকে। ছোটবেলায় শোনা গল্পের সেই ছেলেটার বা সেই গরীবের ডাক্তারবাবুর পরিবার কিনা বলতে পারবো না। কারণ, সেই মানুষটির মানসিকতার সাথে এঁদের কিছুই মেলে না। এক আমার দাদীমা আমার পরিচয় পেয়ে কান্না করলেন। বাকিরা বরং তাড়াতে পারলে বাঁচে। শুধু তাদের বাড়ী থেকেই নয় পৃথিবী থেকে তাড়াতে চায়। তারপর আমার মা আর ওই কেষ্টার নাম জড়িয়ে আকথা কুকথা শোনায়। বুঝলাম, এদের কাছে আমাদের সব খবর আছে। চোখে চোখ রেখে যখন জানতে চাইলাম যে, তাহলে তারা ছোট্ট হানিয়া আর তার মাকে উদ্ধার করেনি কেন? কেন তাদের পাশে দাঁড়ায়নি? তাতে যা উত্তর পেলাম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, সেটাকে সোজা করলে অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে পরিবারের মানুষের স্বার্থেই বড়সড় আঘাত হেনেছিলেন বাজান আমার। আর তাই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার দাদাজান ও তার বাকি ছেলেদের বিশাল প্রোমোটিং এর ব্যবসা, গরীব মানুষদের বস্তি, গ্রাম, চাষের জমি যা কিনতে পারে সেখানেই বড় বড় বিল্ডিং তুলে দেয়। সাথে এমন এক রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া ছিল, যারা গরীবদের উন্নয়নের নামে তাদের পাওনাগন্ডা নিজেদের পকেটস্থ করত। আমার বাজান এদের কাজের একেবারে উল্টোপথে হাঁটায়, নিজের পরিবারের মানুষজনই সরিয়ে দিয়েছে কেষ্টার দেবতাকে।
সময় লেগেছে প্রচুর কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি, শেষ অবধি সবটা প্রমান করা গেছে, কেষ্টা ও তার গ্রামের মানুষদের সহায়তায়। গোটা একটা গ্রাম যখন সাক্ষী হিসেবে দাঁড়ায়, সে মামলার জয় বোধহয় নিশ্চিত হয়েই যায়। উপরন্তু তখনকার বিরোধী দল এখন শাসক দল হয়েছে; পাশা উল্টে যাওয়ায় আমাদের লাভ হয়েছে বৈকি। বাজানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের এবং তাঁর হত্যাকরীদের খুঁজে পাওয়া গেছে, যথাযোগ্য শাস্তি পাচ্ছে তারা। আমি অনেকবার মাকে জিজ্ঞেস করেছি, মা সবটা আন্দাজ করতেন, তবু কেন বাজানের ফিরে আসার কথা বলতেন, প্রার্থণা করতেন? সে কি নিছকই একটা আশা নিয়ে বাঁচা? নাকি নিজেকে ভোলানো? উত্তর পাইনি। হয়ত দুটোই সত্যি।
গাড়ী থাকে নামতেই সেই শক্ত চেহারার কেষ্টা নামের মানুষটাকেই খোঁজে আমার মন। চোখ যদিও এক ঝুঁকে পড়া বৃদ্ধকেই পায়। ফোকলা দাঁতে হেসে যে আমায় বুকে টেনে নেয়। এবারেও তার ব্যতিক্রম নেই। আমি এবারে একে নিয়ে যাবোই আমার সাথে। তার ইচ্ছে অনুযায়ী সেই শহরের দালান বাড়ী হয়েছে আমার। মা কে নিয়ে গেলেও কেষ্টা যায় না কিছুতেই।
“সব যখন ভালো ভাবে মিটেছে, বাজান, এবারে তো চলো তোমার মেয়ের সাথে। আচ্ছা, বলো তো জন্ম না দিলে কি মেয়ে হওয়া যায় না? আমার বাবা বেঁচে থাকলে কি তোমার থেকে কিছু কম করতেন আমার জন্য? আমি আর কোনো কথা শুনবো না। আচ্ছা, আমার কথা নাহয় ছেড়ে দাও; কিন্তু তুমি যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাস তার জন্যও অন্ততঃ চলো। সে মানুষটাতো সারাজীবন মেয়ে বড় করতে করতে আর সমাজের নোংরা মুখ বন্ধ করতে করতে কাটিয়ে দিলো, বলো? এখন শেষ বয়সে এসে তাকে একটু আনন্দ দাও। বলো, তুমি ভালোবাস না মা কে?”
চোখে জল নিয়ে মাথা নাড়ে সে, মিথ্যেটা ঠিক করে বলতেও শিখলো না মিথ্যেবাদী লোকটা।
ঘুমন্ত আগ্নেয়গীরি আর লোহিত বসনা সুন্দরী
Subhadeep Mukherjee
North Carolina, USA

Mount Drum from Glen Highway, Glennallen, Alaska [September 2019]
ঘুম ভাঙতে সেদিন একটু বেলা হয়ে গেছিলো। না, ছুটির দিনের তুলনায় অনেক সকাল, মাত্র ৯ টা বাজে। কিন্তু বেড়াতে এসে অব্দি এত দেরি করে কোনোদিন ঘুম থেকে উঠিনি আমরা। এর একটা কারণ কাল অনেক রাত অব্দি বারবার weather চেক করে গেছি একটা বিশেষ অঞ্চলের। উৎকণ্ঠায় জেগে ছিলাম অনেক রাত অব্দি। আজকে কি দেখা মিলবে ? না আগের দিনের মতোই লুকিয়ে থাকবে ঘন কুয়াশার আড়ালে!
দরজার বাইরে একটু হালকা ঝুটোপুটি আর কুঁই কুঁই আওয়াজ। প্রথম দিন একটু চমকে ছিলাম, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। Milo, আমাদের হোমস্টের হোস্টএস এর ছোট্ট গোল্ডেন ডুডুল। এই কদিনেই আমার খুব ন্যাওটা হয়ে গেছে। রোজ সকালে এসে আমাদের সুপ্রভাত জানিয়ে যায় এভাবেই। তবে আজকে সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুললাম না। আমরা লেট্ অলরেডি। এখুনি বেরোতে হবে।
দুজনে ঝটপট রেডি হয়ে, ক্যামেরা গুছিয়ে, Milo কে একটু চটকে দিয়ে অবশেষে গাড়িতে বসে পড়লাম। সেপ্টেম্বর এর মাঝামাঝি সময় আলাস্কার এই অঞ্চলে (Achorage আর আশে পাশের এলাকা) ঠান্ডা খুব বেশি নয়। কিন্তু যেখানে আমরা চলেছি, সেখানে ঠান্ডা একটু বাড়বে আশা করেছি। তাই জ্যাকেট আর বুট নিতে হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য, আমেরিকার সর্ববৃহৎ (largest) ন্যাশনাল পার্ক, Wrangell-St. Elias. Anchorage শহর থেকে প্রায় ২০০ মাইল পূর্বে, গ্লেন হাইওয়ের অপর প্রান্ত। কিন্তু পার্কের ভিতর আমাদের যাওয়ার কথা নয় এবারে। আমাদের আসল লক্ষ্য Glennallen শহর এর ১০ মাইল আগে, রাস্তার ওপর একটা বিশেষ জায়গা। দুদিন আগেই যেখান থেকে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।
প্রায় ৬ মাস আগে যখন প্রথম আমরা আমাদের আলাস্কা ঘোরার পরিকল্পনা করি, তখন হটাৎ ই দ্যুতি এই বিশেষ জায়গাটা আবিষ্কার করে। তারপর দুজনে মিলে খুঁজে বের করি সেটার মোটামুটি কাছাকাছি একটা লোকেশন। ছবি তে যে জায়গা আমাদের মুগ্ধ করে দিয়েছিলো, ভাবছিলাম সামনে থেকে তাহলে আমরা কিরকম দেখবো। উচ্চতায় ১২০০০ ফুট, এই ঘুমন্ত আগ্নয়গিরীর নাম মাউন্ট ড্রাম। আজ থেকে ৮০০০০০ বছর আগে শেষ বার অগ্ন্যুদ্গার করেছিলো সে। এখন তুষারাবৃত অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে, চিরকালের মত।
বেরোনোর পর প্রতিদিনের মতোই আমাদের প্রথম কাজ থাকে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ এর জন্য কিছু শুকনো স্যান্ডউইচ টাইপের খাবার তুলে নেওয়া। সেটা করে তারপর পুরোদস্তুর একেবারেই গাড়ি চালানো। আর থামবার দরকার পরে না। Palmer শহর পার হওয়ার পর থেকেই শুরু হলো জঙ্গল, পাহাড় আর নদীর পথ দিয়ে রাস্তা। চারিদিকে এক অনির্বচনীয় সুন্দর প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। এখন পাতা ঝরার মরশুম এর শুরু, রঙে রঙে একাকার প্রতিটা গাছ, গুল্ম , লতা। তার স্থির ছায়া এসে পড়েছে ছোট ছোট জলাশয়ের উপর। পথের ধারে মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম সেই ছবি ক্যামেরা বন্দী করতে। আগের দিনের মতো এবারেও রাস্তার পাশে পড়লো বিখ্যাত Matanuska Glacier, কিন্তু যেহেতু আগেরদিন আমরা খুব ভালো করে দেখে নিয়েছিলাম, আজকে সেখানে আর দাঁড়ালাম না। সময় খুব কম। ফোন এর weather app বলছে দুপুর ১২-১ টা অব্দি শুধু আকাশ পরিষ্কার থাকবে। তা ছাড়া পুরো সময় মেঘ আর কুয়াশা।
এই পথে, Glennallen শহরের আগের শেষ gas station এ একবার দাঁড়াতেই হলো কারণ Glennallen এ কতটা কি পাওয়া যায়, তখন আমাদের ধারণা ছিলো না। তারপর আবার পূর্ণদস্তুর ড্রাইভ। আর থামা নেই। এখন ও যেতে হবে অন্তত ৩০ মিনিট। দুপুর ১২ টা বাজতে বেশি দেরী নেই আর।
অবশেষে ১২ টা বাজার একটু পরেই আমরা সেই নির্দিষ্ট মাইলফলক এ পৌঁছলাম। কিন্তু রাস্তার সামনের দিকে তাকিয়ে আবার মনটা হতাশায় ভরে গেলো। এতো নিশ্ছিদ্র কুয়াশা! সঙ্গে জমা হয়েছে প্রাকৃতিক দাবানল এর ধোঁয়াশা। তবে কি আজকেও আসা বৃথা? দেখা মিলবে না অগ্নিদেবের ঘুমন্ত কুন্ডের?
গাড়িটা রাস্তার পাশে রেখে ধৈর্য রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কোনোদিকে জনমানব নেই, এই এতটা রাস্তায় হাতে গোনা কিছু গাড়ি আমাদের চোখে পড়েছে। ১ টা বাজতে আর বেশি দেরি নেই......
আরে কুয়াশা কি একটু কেটে গেছে? সামনে, আকাশের মাঝে, ওটা কি???
অবশেষে দেখা মিললো তবে! এত দূর আসা, এত পরিকল্পনা, এত উৎকণ্ঠা .......সার্থক!! আমাদের সামনে রয়েছে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া গ্লেন হাইওয়ে, আর সেই দিগন্তের একটু উপর থেকে, যেন আকাশের মাঝামাঝি অঞ্চলে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মাউন্ট ড্রাম! চিরতুষারাবৃত চূড়া দুপুরের রোদে ঝকঝক করছে। চূড়ার নিচে জমে আছে মেঘের পরদ , যাতে আরো মনে হচ্ছে এ পর্বতের ভিত যেন মাটিতে নেই, মেঘের উপরেই তার বাস।
দুজনে কতক্ষন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম জানিনা। ঘোর কাটলে ছবির পর ছবি নিতে শুরু করলাম। এর মধ্যেই দেখা মিললো লাল রঙা কোনো এক ভিনটেজ গাড়ির, ছবি যেন যার জন্য আরো একটা নতুন মাত্রা পেলো। কিন্তু কোনো ছবিতে এই সৌন্দর্য ধরে রাখা কি সম্ভব? মহাসাগরের জল এক মুঠোর মধ্যে ধরা যায় না! সে চেষ্টাও আমি করিনি।
মনের মনিকোঠায় সেই ছবিকে সযত্নে বসিয়ে রেখে ফেরার পথ ধরলাম। আর নিজের কাছেই যেন, সেই অপরূপ প্রকৃতি কে সাক্ষী করে একটা প্রতিজ্ঞা করলাম। আমরা আবার ফিরে আসবো......আসতেই হবে আমাদের ফিরে........